ইতিকাফ: মহিমান্বিত একটি আমল

‘ইতিকাফ’ আরবী শব্দ। ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা, কোনো স্থানে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরীআতে ইসলামীর পরিভাষায় ইতিকাফ হল,
ইবাদত ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে পুরুষদের জন্য মসজিদে এবং মহিলাদের জন্য আপন ঘরে নামাযের জায়গায় অবস্থান করা। ইতিকাফ এমন একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত¬যার প্রচলন ইসলামের বহু পূর্ব থেকেই রয়েছে। নামায ও অন্যান্য ইবাদতের সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় খলীল হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম ও নবীপুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামকে ইতিকাফকারীদের জন্য বায়তুল্লাহকে পবিত্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম তোমরা আমার ঘরকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। -সূরা বাকারা (২) : ১২৫

রমাযানের ইতিকাফের গুরুত্ব

(তরজমা) রমযানের বিশ তারিখের সূর্যাস্ত থেকে ঈদের চাঁদ উঠা পর্যন্ত ইতিকাফ করাকে মাসনূন ইতিকাফ বলে। হাদীস
শরীফে আছে, (তরজমা) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭১
মাহে রমযানে ইতিকাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। রমযানের ফযীলত বরকত; বিশেষত লায়লাতুল কদরের ফযীলত ও বরকত পাওয়ার জন্য ইতিকাফের গুরুত্ব বর্ণনাতীত ও অপরিসীম। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর মাহে রমাযানে গুরুত্বের সাথে ইতিকাফ করতেন। কোনো বছরই তিনি ইতিকাফ ছাড়তেন না। তাঁর মাদানী জীবনে মাত্র একটি রমাযানে জিহাদের সফরের কারণে ইতিকাফ করতে পারেননি। তবে পরবর্তী
বছর বিশদিন ইতিকাফ করে তা পূর্ণ করে নিয়েছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৮০৩

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ইতিকাফে শরীক হতেন। তাই ইতিকাফ একটি মর্যাদাপূর্ণ মাসনূন
আমল যা ‘শিআরে ইসলাম’ও বটে। এমনকি কোনো মসজিদ ইতিকাফশূন্য থাকলে পুরো এলাকাবাসী সুন্নাতে মুআক্কাদা বর্জনের কারণে গুনাহগার হবে।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমযানে দশদিন ইতিকাফ করতেন। তবে ওফাতের বছর
বিশদিন ইতিকাফ করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৪৪

ইতিকাফের ফযীলত
ইতিকাফের ফযীলত সম্পর্কে একটি হাদীসের ভাষ্য নিম্নরুপ, (তরজমা) যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান যমীনের মাঝে যত দূরত্ব আছে তার চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন।-শুআবুল ঈমান, হাদীস ৩৯৬৫
আরেক হাদীসে আছে, (তরজমা) যে ব্যক্তি রমাযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করবে (তার ইতিকাফ) দুটি হজ্ব ও দুটি উমরার সমতুল্য হবে। -শুআবুল ঈমান, হাদীস ৩৯৬৭

ইতিকাফের উপকারিতা
১. শবে কদর লাভের অন্যতম মাধ্যম হল ইতিকাফ। হাদীস শরীফে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম রমাযানের মাঝের দশদিন ইতিকাফ
করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমাযানের একুশতম রাত এল (অর্থাৎ যে রাত গিয়ে সকালে তিনি ইতিকাফ থেকে বের হবেন) তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ, আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের অমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। …সুতরাং তোমরা শেষ দশকে শবে কদর খোঁজ করো। -সহীহ বুখারী, হাদীস
২০২৭
২. ইতিকাফকারী অবসর সময়ে কোনো আমল না করলেও তার দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হয়।
৩. ইতিকাফের বদৌলতে অনেক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়।
৪. ইতিকাফ দ্বারা দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহ তাআলার কাছে সঁপে দেওয়া যায়। রোযার কারণে পুরো দিন ফিরিশতাদের সাথে (পানাহার ও যৌনকর্ম বর্জন দ্বারা) সামঞ্জস্য হয়। আর ইতিকাফের দ্বারা চব্বিশ ঘণ্টা ফিরিশতাসূলভ আচরণের উপর অবিচল থাকার চমৎকার প্রশিক্ষণ হাসিল হয়।
৫. রোযার যাবতীয় আদব ও হক যথাযথ আদায় করে পরিপূর্ণ রোযা আদায় করার জন্য ইতিকাফ যথেষ্ট সহায়ক।
৬. আল্লাহ তাআলার মেহমান হয়ে তাঁর সাথে মুহাব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি করার অন্যতম মাধ্যম এবং সশ্রদ্ধ একান্ত সংলাপের জন্য ইতিকাফের বিকল্প বিরল।
৭. মসজিদে অবস্থান করার কারণে ইতিকাফকারী যে সকল আমল করতে অক্ষম যেমন জানাযায় শরীক হওয়া, অসুস্থদের সেবা করা ইত্যাদি-এসব আমল
না করেও এসবের সওয়াব সে পেতে থাকে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফকারীর ব্যাপারে
বলেন, ইতিকাফকারী গুনাহসমূহ থেকে পবিত্র থাকে। আর সকল নেককর্ম সম্পাদনকারীর মতই তাকে সমস্ত নেককাজের সওয়াব দেওয়া হয়। -সুনানে
ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭১৮
উল্লিখিত আলোচনা থেকে ইতিকাফের গুরুত্ব, ফযীলত ও উপকারিতা আমাদের সামনে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে আশা করি। সুতরাং হাদীসে বর্ণিত ফযীলত ও বরকত লাভের আশায় আসন্ন রমযানে আমরা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত এই আমলটিতে হৃষ্টচিত্তে শরীক হতে পারি। আল্লাহ সুবহান আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন! আমীন!

মুহাম্মাদ আবদুস সবুর/ইফতা ১ম বষ

Leave a Comment