প্রশ্ন
বরাবর,
দারুর ইফতা
আশরাফুল মাদারিস, সতীঘাটা, সদর, যশোর। তারিখ ১৯/১২/২০২২ঈ.
বিষয়: নামায সংক্রান্ত মাসয়ালা জানার আবেদন।
মুহতারাম,
সৌদি প্রবাসীগণ এই ব্যাপারে আপত্তি করে যে, আরবে আসর নামাযের জামাত আওয়াল ওয়াক্তে আর বাংলাদেশে শেষ ওয়াক্তে আদায় করা হয়। অথচ ইসলাম প্রচারের সূচনা আরব থেকে হয়েছিল, তাই উচিৎ হলো, ইসলামী বিধান পালনে তাদের ফলো করা। তাহলে আমরা আসরের নামায আওয়াল ওয়াক্তে না পড়ে শেষ ওয়াক্তে কেন পড়ি?
সম্মানিত মুফতী সাহেবের নিকট নিবেদন হলো, আসরের নামায কখন পড়া উত্তম? দলীলসহ এ বিষয়ের একটি সমাধান কামনা করছি।
বিনীত নিবেদক
মুহাম্মাদ মেহেদী হাসান, যশোর
উত্তর
ফাতাওয়া নং- ২৬৭
بسم الله الرحمن الرحيم
الجواب حامدا و مصليا و مسلما
আসরের ওয়াক্ত শুরু হয় যোহরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই। কিন্তু আসরের নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্ত হল, শীত-গরম সব সময় আসরের নামায দেরী করে পড়া। অর্থাৎ সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়ার আগে স্বচ্ছ-উজ্জ্বল থাকতেই আসরের নামায আদায় করা মুস্তাহাব।
** কুরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে,
وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ طَرَفَيِ ٱلنَّهَارِ وَزُلَفٗا مِّنَ ٱلَّيۡل. ( سورة هود:الأية-১৪৪)
অর্থ, “এবং (হে নবী) আপনি দিনের উভয় প্রান্তে নামায আদায় করুন”।
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় দিনের শেষ সময়ের নামায অর্থাৎ আসর নামায একেবারে শেষ সময়েই আদায় করা উচিৎ। তবে যেহেতু সূর্যের রং হলুদ বর্ণ হওয়া পর্যন্ত আসর নামায বিলম্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে। এজন্য শেষ সময়ের অর্থ ‘সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়ার আগ মূহুর্ত’ বুঝে আসে। সুতরাং আসরের নামায দিনের শেষ সময় অর্থাৎ সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়ার আগ মূহুর্তে আদায় করা উত্তম। এতে কুরআনের আয়াতের মর্ম সঠিকভাবে আদায় হয়।
** হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
*عَلِيِّ بْنِ شَيْبَانَ قَالَ: ্রقَدِمْنَا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ فَكَانَ يُؤَخِّرُ الْعَصْرَ مَا دَامَتِ الشَّمْسُ بَيْضَاءَ نَقِيَّة.
অর্থাৎ আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মদীনায় এলাম। তিনি আসরের নামায সুর্যের আলো স্বচ্ছ পরিস্কার হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করেছেন।- ইবনে আবি শায়বা, ৭৪০২; মুসনাদে আহমাদ, ৬১০; আবু দাউদ, ১২৭৪;
অন্যত্র এসেছে,
*عن رافع بن خديج يقول: أن رسول الله صلي الله عليه و سلم كان يأمر بتأخير العصر.
অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের নামায দেরীতে পড়ার আদেশ করেছেন।- আল মুজামুল কাবীর তাবরানী, ৪৩৭৬;
হযরত আবু মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের নামায আলো কমে সূর্য স্বচ্ছ হয়ে যাওয়ার পরে আদায় করতেন।- তিরমিযি, ১৫২; আবু দাউদ, ৩৫৯;
হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের নামায এমন সময় আদায় করতেন সূর্য যখন পরিষ্কার হয়ে যেত।- মুসনাদে আহমাদ, ১২৩৫৬; ইবনে আবী শায়বা, ৩৩১৭;
এ সমস্ত হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণ হয় আসরের নামায বিলম্বে পড়া মুস্তাহাব। কারণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা আসরের নামায সূর্যের রং হলুদ বর্ণ হওয়ার আগ মূহুর্তে তেজ কমে সূর্য যখন পরিষ্কার স্বচ্ছ হয়ে যেত তখন আদায় করতেন, এবং তিনি আসরের নামায বিলম্বে পড়ার নির্দেশও দিয়েছেন।
তবে কিছু বর্ণনা এবং ঘটনা এমন আছে যা থেকে বাহ্যিকভাবে বুঝে আসে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের নামায আওয়াল ওয়াক্তে পড়তেন। কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে তিনি বিলম্ব করেই পড়তেন বুঝে আসে।
হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের নামায এমন সময় আদায় করতেন যখন সূর্য উঁচু থাকতো। অত:পর কোন পথিক মদীনার উঁচু এলাকায় গিয়ে সেখানে সূর্যকে উঁচু অবস্থায় পেত।-আবু দাউদ, ৪০৪; অন্য বর্ণনায় এসেছে, অত:পর কোন পথিক কুবায় গিয়ে দেখতেন, তারা এখনো নামায আদায় করছে।- বুখারী, ৫৫১; মুসলিম, ১৯৩;
হযরত আবু আরওয়া রা. বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের সাথে আসরের নামায পড়ে যুল হুলায়ফার দিকে যাওয়া শুরু করলাম এবং সেখানে সূর্য ডুবার আগেই পৌঁছে গেলাম।- শরহু মাআনিল আসার, ১১৪২;
এই সকল হাদীস দ্বারা আসরের নামায আওয়াল ওয়াক্তে পড়ার কথা প্রমাণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এ সকল হাদীস দ্বারা সেটা প্রমাণ করা যায় না। কেননা, হাঁটা-চলার পরিমাণ দ্বারা ওয়াক্ত নির্ধারণ হয়না। কেউ জোরে হাঁটে আর কেউ আস্তে। কোন ব্যক্তি খুব জোরে হেঁটেছে এবং ওয়াক্তের মাঝে আসরের নামায আদায় করেছে এরপরে যুল হুলায়ফায় মাগরিবের আগে পৌঁছে গেছে।
এছাড়া উক্ত হাদীসসমূহে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আসরের নামায দেরীতে পড়াই বুঝে আসে। কারণ, হাদীসেوالشمس حية مرتفعة শব্দ এসেছে, যা সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়ার নিকটবর্তি সময় পর্যন্ত দেরী করা প্রমাণ করে। অন্যথায় হাদীসের শব্দ এভাবে আসতো যে, صلي في اول الوقت والشمس حية ‘তিনি প্রথম ওয়াক্তে আসরের নামায আদায় করেছেন যখন সূর্য উঁচু ছিল’।
এরপরও আওয়াল ওয়াক্তে আসরের নামায পড়া যদি উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা হয়, তবুও বিলম্ব করে নামায পড়ার হাদীসসমূহ অগ্রগণ্য হবে। কেননা আসরের নামায বিলম্ব করে পড়ার জন্য হাদীসে আমর তথা নির্দেশ এসেছে। আর আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়া সম্পর্কিত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফে’ল তথা কর্ম ও ঘটনার বিবরণ রয়েছে, তাতে কোন আদেশ নেই। আর আমর বা আদেশসূচক হাদীস; ফে’ল বা কর্ম সংক্রান্ত হাদীসের উপর প্রাধান্য পায়।
তাছাড়া عصر (আসর) শব্দের মধ্যেই বিলম্বের অর্থ রয়েছে। (عصر -আসর- শব্দের অর্থ, নিংড়ানো) অর্থাৎ আসরের নামাযকে عصر (আসর) নামকরণ করা হয়েছে, কেননা দিনকে নিংড়ে বিলম্বে, শেষ সময়ে এই নামায পড়া হয়।
আসরের নামায বিলম্ব করার আরও হেকমত হলো, এর দ্বারা বেশি পরিমাণে নফল নামায আদায় করা যায়। কারণ, আসরের পরে নফল নামায পড়া মাকরূহ। সুতরাং আসরের নামায বিলম্ব করাই উত্তম এবং এ কারণেই মাগরিবের নামায দ্রুত পড়া উত্তম। কেননা মাগরিবের আগে কোন নফল পড়া মাকরূহ।
এ সকল আয়াত, হাদীস ও পর্যালোচনা দ্বারা আসরের নামায শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করাই উত্তম প্রমাণিত হয়।
উল্লেখ্য, ইসলামের বিধি-বিধান পালনে কোন স্থান বা ভূমির কোন নির্ভরশীলতা নেই। বরং কুরআন- হাদীসের আলোকেই সকল শরঈ বিধিমালা প্রণীত হয়। সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর আবশ্যক।
উত্তর লিখনে
ফাতাওয়া বিভাগ
আশরাফুল মাদারিস (সতীঘাটা মাদরাসা)
সতীঘাটা, সদর, যশোর, বাংলাদেশ