১৪১৭ হিজরির ২৮ রজব ইশার নামাযের পরে আনুমানিক রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তিরমিযী শরীফের ১ম খণ্ড সমাপ্ত হয়। সে সময় হযরত ফুযালাদের উদ্দেশ্যে মূল্যবান নসীহত পেশ করেন। যা পরবর্তীতে তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তুহফাতুল আলমাঈ’ এর ৫ম খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়। বিষয়টি সময়োপযোগী ও উপকারী মনে করে আলইরশাদের পাঠকের সমীপে অনুবাদ তুলে ধরা হল। -সম্পাদক
প্রিয় ছাত্রবৃন্দ! সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। রাত অনেক হয়েছে। এজন্য এখন দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নেই। তারপরও পুরো বছর সময়ে সময়ে তোমরা আসাতিয়ে কেরামের মূল্যবান নসীহতে অনুপ্রাণিত হয়েছো। এখন এটারও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু নিজের জীবনে পরিবর্তন ঘটানোর এবং কথাবার্তা-কাজকর্ম, চাল-চলন, আলাপ-আলোচনা, রীতিনীতি ও ব্যবহার-আচারকে সুন্দর করার। এই ফিকির তৈরি করার চেষ্টা করা যে, আমাদের আমল-আখলাক, আমাদের জীবন পরিচালনার রীতিনীতি এবং কথোপকথন ও কাজকর্ম সবকিছু সেই পবিত্র নবীজীবনের সাথে মিলে যায়। যা আমরা সারা বছর সকাল-সন্ধ্যায় পড়েছি। আমাদের অবশ্যই মুসলিম উম্মাহর সুপুত্র হতে হবে। এই উদ্দেশ্যে আমি সংক্ষিপ্ত সময়ে চারটি বিষয় আলোচনা করব। খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো।
প্রথম কথা
প্রিয় তালেবে ইলম! সন্তান-পুত্র তিন ধরনের হয়ে থাকে। পুত্র, সুপুত্র আর কুপুত্র। যে সন্তান শুধু পুত্রই হয় অর্থাৎ যে পিতার নাম আলোকিত করে না আবার বদনামও করে না; সে পুত্র। যে সন্তান পিতার নাম আলোকিত করে সে সুপুত্র। আর যে পিতার বদনাম করে যে কুপুত্র। এখন তোমাদের এক ধরনের জীবন শেষ হয়ে অন্য জীবন শুরু হবে। তোমাদেও ভাবা উচিত যে, তোমাদেরকে কারা পড়িয়েছেন? যদি মনে করো তোমাদেরকে মা-বাবা পড়িয়েছেন- এটা ভুল ধারনা। যদি এই মাদরাসা এবং এসকল আসাতিযা না হতেন তাহলে মা-বাবা কিভাবে পড়াতেন? আর যদি মনে করো যে, উস্তাদগণ আমাদেরকে পড়িয়েছেন- এটাও ভুল। যদি এই মাদরাসা না থাকত, উস্তাদগণ কিভাবে পড়াতেন? যদি ভাবো যে, দ্বীনী প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদেরকে পড়িয়েছেন- এটাও পুুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ মুসলিম জাতি সহযোগিতার হাত না বাড়ালে এসকল প্রতিষ্ঠান কিভাবে হত! তাই বাস্তবিকপক্ষে মনে হয়, মুসলিম জাতি তোমাদেরকে পড়িয়েছে।
আমার প্রিয় ছাত্রবৃন্দ! খুব ভালো করে জানো যে, মুসলিম জাতি তোমাদেরকে পড়িয়েছে। এখন দেখতে হবে যে, তোমরা মুসলিম জাতির দায়িত্বের ব্যাপারে পুত্র হবে, সুপুত্র হবে নাকি বা কুপুত্র? তোমাদের কর্মই এর ফায়সালা করে দিবে। তুমি যদি কেবল নিজের দ্বীনের হেফাযত করো, অন্যদিকে মুসলিম জাতির কোনো উপকার করতে না পারো তবে তুমি পুত্র। আর যদি নিজের দ্বীনের হেফাযতের সাথে মুসলিম উম্মাহর উপকার করে থাকো তাহলে তুমি সুপুত্র। মুসলিম উম্মাহকে ফায়দা দেওয়ার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য যেই পন্থা নির্বাচন করবেন, তুমি সেটাই অবলম্বন করবে। তুমি তাবলীগে যাবে, কিতাবাদি রচনা করবে, মক্তব-মাদরাসায় পড়াবে। মসজিদে ইমামতি করবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে একাধিক পন্থায় জাতির খেদমত করা। আর যদি জাতির কোনো ফায়দা না হয় বা নিজের দ্বীন ঠিক না থাকে; বরং কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলে অথবা কোনো কাজকর্ম শুরু করে দিলে। এদিকে না তোমার দ্বীনের কোনো খোঁজ থাকল, না দাড়ি ঠিক থাকল, আর না নামাযের কোনো খবর থাকল। সাথে সাথে তোমার আমল-আখলাক ও কথাবার্তাও নষ্ট হয়ে গেল তাহলে তো তুমি কূপুত্র হয়ে গেলে।
কাজকর্ম করতে চাইলে পূর্ণ আগ্রহের সাথে করো। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাইলে মনোযোগ সহকাওে পড়ো। যে কাজই করতে ভালো লাগে সেটা করো। কিন্তু দশ-পনের বছর ধওে যে ইলম শিখেছো তা ছেড়ে দিওনা। বরং দ্বীনের আঁচলকে আঁকড়ে ধরো। যদি তোমার জীবন থেকে দ্বীন বের হয়ে যায় তাহলে তোমার চেয়ে বড় দূর্ভাগা আর কেউ নেই। যে জাতির থেকে খেলো, অথচ সে না জাতির খেদমত করল, না নিজের দ্বীন ঠিক রাখল, সে তো خسر الدنيا والآخرة (দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থ) এর মিসদাক হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা এ থেকে আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।
দ্বিতীয় কথা
প্রিয় তালিবুল ইলম! তোমরা এখন নতুন পথের যাত্রী হবে। তোমাদের জীবনের পাতা পরিবর্তন হচ্ছে। এখন তোমাদের জন্য বিশেষভাবে আগামী ভবিষ্যতের জন্য দুআ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুক। তোমাদের জীবনে দ্বীন বাকি রাখুক, তোমাদের চেষ্টার মাধ্যমে দ্বীনের উন্নতি দান করুক, তোমাদের মাধ্যমে উম্মতে মুসলিমাকে বরকতময় করুক- এই দুআ করো। তুমি যদি খাঁটি দিলে আল্লাহর কাছে চাও তাহলে জেনে রেখ, আল্লাহ তাআলার কাছে অনুগ্রহের কোন কমতি নেই। আর যদি বেপরওয়া ভাব দেখাও তাহলে শুনে রাখ তিনি কারো প্রতি মুখাপেক্ষী নন। তিনি দ্বীনের কাজ অন্য কারো দ্বারাও করাতে পারেন। তোমার স্মরণ থাকার কথা- এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম তিরস্কারের শিকার হয়েছেন, অথচ তাদের আর আমাদের মাঝে কোন তুলনা হতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে তিনি (আল্লাহ তাআলা) তোমাদের স্থানে আরেকটি জাতিকে আনবেন যারা তোমাদের মত হবে না। -সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮
আমরা সকলে আল্লাহ তাআলার মোহতাজ; তিনি কারো মোহতাজ নন। এজন্য খাঁটি দিলে কাঙালের ন্যায় তার কাছে চাও, হয়ত আল্লাহ তাআলা তোমাকে দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করবেন। আর যদি তোমার মন এদিকে না ঘোরে তাহলে মনে রেখ আল্লাহ তাআলা কারো মোহতাজ নন। তিনি চাইলে দ্বীনের কাজ পাখিদের দ্বারাও নিতে পারেন। চাইলে নও মুসলিমদের দ্বারা বা অন্য কারো দ্বারাও নিতে পারেন। তিনি দ্বীনের কাজের জন্য দারুল উলূম দেওবন্দের ফুযালাদের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। বরং এসকল ফুযালা আল্লাহ এবং তার দ্বীনের প্রতি মোহতাজ, আল্লাহর দ্বীনের খেদমতের মোহতাজ। সেজন্য দুআ কর যেন আল্লাহ তাআলা তোমাকে সঠিকতা ও সফলতা দান করেন। তোমাকে তার দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করেন। তোমার মাধ্যমে মুসলিম জাতির উন্নতি দান করেন। তোমার মাধ্যমেই মাদারে ইলমী তথা দারুল উলূম দেওবন্দেও নাম সারা বিশে^ও সামনে আলোকিত করেন এবং ইসলামী মাদরাসাগুলোর পিছনে খরচকারীদেও উভয় জগতের প্রভ‚ত কল্যাণ দান করেন। এটা মুসলিম মিল্লাতের একপক্ষ থেকে একটা বড় ইহসান যে তারা একেকটি পয়সা বাঁচিয়ে মাদরাসাকে সাহায্য করছে। যার কারণেই আজ দ্বীনের এ সজীবতা। অন্যথায় দ্বীনের এ সজীবতা কোথায় পেতে? ফুযালাদের সংখ্যা তো অনেক বেড়েছে; কিন্তু কাজের লোক কোথায়!
তৃতীয় কথা
আমি এটা বলব যে, এ যামানায় ইলমে দ্বীন অর্জনকারী ও উলামা-ফুযালাদের সংখ্যা তো অনেক বেড়েছে; কিন্তু যোগ্যতা ও ইসতিদাদ অনেক কমে গেছে। এর কারণ কী? এবং এর থেকে মুক্তির উপায় কী? প্রথমে এটা জানা জরুরি যে, প্রত্যেক বছর শুধুমাত্র হিন্দুস্তান থেকেই ৩০০০ উলামা-ফুযালা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা এই যে, প্রাথমিক আরবী কিতাব পড়ানোর মত তো অনেক উস্তাদ পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু উঁচু স্তরের কিতাব পড়ানোর মত উস্তাদেও সংখ্যা প্রায় শূন্যেও কোঠায়। আর এটা হয়েছে মূলত দুই কারণে।
১ম কারণ: মাদরাসা শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্ররা দুটি শব্দের পিছনে পড়ে গেছে। ১। আমি ফারেগ হয়ে গিয়েছি। ২। আমি হলাম ফাযেল। এটা স্পষ্ট বিষয় যে, যখন আমি ভাববো, আমি ফারেগ হয়ে গিয়েছি, আমার আর কোন কিছু বাকি নেই। তাহলে আমি কিভাবে পূর্ণতায় পৌঁছাবো? তোমরা জানো যে, মাদারিসে আরাবিয়্যায় ছাত্রদেরকে ইলম দেওয়া হয় না। বরং ইলমে দ্বীন অর্জনের যোগ্যতা তৈরী কওে দেওয়া হয়। পড়াশোনা তো এখান থেকে বের হওয়ার পর শুরু হবে এবং জীবনভর চলতে থাকবে। দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পরেই তোমার পূর্ণতা অর্জন হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা তো হল এই যে, শিক্ষা সমাপনকারীদেও উপর ফারাগাতের একটা বাতাস লেগে গেছে। সে ভাবে, পড়াশোনার যা দরকার ছিল তা হয়ে গেছে। এখন আর কোনো কিছু বাকি নেই। সুতরাং মাদরাসা থেকে বের হওয়ার পর আর কোন পড়াশোনা নেই। তবে কদাচিৎ যদি কখনো প্রয়োজন পড়ে তাহলে ততটুকু পড়লেই চলে। তবে কিছু ছাত্র আছে যারা এরপরও নিজের মুতালাআ চালিয়ে যায়। আর এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, ইলম পড়ার দ্বারাই অর্জন হয়; পড়ানোর দ্বারা নয়। ছাত্রদের পড়ার মধ্যে তিনটা বিষয় অন্তভর্‚ক্ত থাকে।
ক) মুতালাআ করে সবকে উপস্থিত হওয়া। যে তালেবে ইলম সামনের সবক মুতালাআ ছাড়াই দরসে যায় সে দরসে পড়তে যায় না বরং পড়াতে যায়। অর্থাৎ তার কারণেই উস্তাদকে পড়াতে হয়। যদি সে দরসে না যেত তাহলে উস্তাদও পড়তেন না। পাঠক তালেবে ইলম তো সেই যে সামনের সবক মুতালাআ করে দরসে বসে। মুতালাআয় নতুন সবক বুঝা জরুরি নয়। বুঝে আসুক বা না আসুক কমপক্ষে ইবারত পড়ে উস্তাদের কাছে যাওয়া উচিত।
খ) দরসে মেধাকে উপস্থিত রেখে কিতাবের একেকটি শব্দ হল (আয়ত্ব) করার চেষ্টা করবে। কোন কিছু অস্পষ্ট রেখে যাবে না। আজকাল ছাত্রদের অবস্থা হল- সবক বুঝে আসলে খুশিও হয় না। আবার না বুঝলেও কোন দুঃখ লাগে না। অথচ সবক বুঝে না আসলে তো চোখের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। যদি কোন তালেবে ইলমের নিয়মিত মুতালাআ করা এবং পূর্ণ মনোযোগিতার সাথে সবক শোনার পরও বুঝে না আসে তাহলে বুঝতে হবে তার ইসতিদাদের কমতি আছে। তাকে পিছে ফিরে দেখতে হবে এবং এমন স্তর থেকে পড়তে হবে যেটা তার ইসতিদাদ অনুযায়ী হবে। এটা না করে যদি দুর্বলতা নিয়ে চলতে থাকে তাহলে সামনে আরো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং এই ইলমী সফরে তার কোন কিছুই অর্জন হবে না। বর্তমানে বেশির ভাগ এমনই দেখা যায় যে, ছাত্ররাও উপরের দিকে উঠতে চায় আর মাদরাসা কতৃপক্ষও এমনই চায়। ছাত্ররা যে স্তরের আবেদন করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে সে স্তরে উঠিয়ে দেয়। সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করে তার ইসতিদাদের উপযুক্ত কোন স্তরে ভর্তি করে না। যার দরুণ সে ফারেগ তো হয় কিন্তু কিছুই অর্জন করতে পারে না। এতে মাদরাসার সকল ব্যবস্থাপনায় ত্রæটি দেখা দেয়।
গ) পঠিত সবক ইয়াদ করা পানির উপর নকশা করার মত। যেটা এক দুইদিনে তালিবুল ইলম ভুলে যায়। সুতরাং যে ছাত্র সবক ইয়াদ কওে না সে কেমন যেন হাতের মধ্যে ফাঁকা রেখে পানি পানের চেষ্টা করছে। স্পষ্টতই তার মুখ পর্যন্ত পানি পৌঁছবে না, ছিদ্র দ্বারা নিচে পড়ে যাবে। এখনকার ছাত্রদের অবস্থা এমনই সে হাতে ফাঁকা রেখেই পানি পানের চেষ্টা করে। সবক ইয়াদ করে না এবং যা পড়েছে তাও সংরক্ষণ করে না। তাহলে তার পড়ে কী লাভ?
অনুরূপভাবে উস্তাদগণের পড়ার ক্ষেত্রেও তিনটি বিষয় অন্তভর্‚ক্ত।
১। ফন (বিষয়) আয়ত্ব করা। ফন দেখে পড়াবে, শুধু শরাহ দেখে পড়াবে না। যে কিতাব পড়াবে সেটা যে ফনেরই হোক সেই ফনের উপর নীচের সকল কিতাব ভালভাবে দেখে নিবে। যেমন ধরে নাও তুমি কুদূরী কিতাব পড়াবে তাহলে বেহেশতি জেওর, তালিমুল ইসলাম পর্যন্ত যে কিতাবই নিচের দিকে লেখা হয়েছে তা দেখে নিবে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো মাসআলার ক্ষেত্রে বড় কিতাবের তুলনায় নীচের দিকের কিতাবের ব্যক্তকরণ অনেক সুন্দর হয়; উপরের কিতাবে যা সহজে আয়ত্বে আসে না এবং বুঝানোর পদ্ধতিও সেখান থেকে অর্জন হয়। আর উপরের দুররে মুখতার, শামী, হেদায়া এবং ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী ইত্যাদি সকল কিতাবে সংশ্লিষ্ট মাসআলাগুলো দেখে নিবে। এর দ্বারা বিষয় স্পষ্ট হবে এবং যোগ্যতাও বাড়তে থাকবে। সে তুলনায় ধারাবাহিক মুতালাআ ততটা ফায়দাজনক নয়। তালিমুল ইসলাম, বেহেশতি জেওর, দুররে মুখতার ধারাবাহিকভাবে মুতালাআ করার তুলনায় নির্দিষ্ট কিতাবের যে মাসআলার সবক হবে সেই মাসআলা উপর নীচের কিতাব থেকে দেখে নিবে। একই মাসআলা বিভিন্ন কিতাব থেকে দেখলে ইয়াদও হবে এবং সহজে বুঝেও আসবে।
২। প্রত্যেক কিতাবের জরুরি বিষয় বা ইবারতের সারনির্যাস বের করে তা নোট আকাওে বা মার্ক করে সংরক্ষণ করবে। চাই কিতাবের মধ্যে পৃষ্ঠা রেখে হোক কিংবা ডায়েরিতে লিখে হোক। যেটা যেখানে উপযুক্ত মনে হয় সেটা হুবহু বা তার সারাংশ লিখে নিবে। এর উপকার হল, সেটার জন্য বারবার কিতাব খুলে দেখা লাগবে না। সারসংক্ষেপ তার কাছে সংরক্ষিত থাকলে প্রত্যেক বছর এটার উপর নজর দিলে সমস্ত বিষয় ইয়াদ হয়ে যাবে। এখানে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, কোন কিতাবের জন্য কোন শরাহ (সহায়ক গ্রন্থ) যথেষ্ট নয়। যদি শরাহ দ্বারাই কিতাব হল হয়ে যেত তাহলে নতুন নতুন শরাহ লেখার প্রয়োজন পড়ত না। অথচ কিতাবের শরাহ তো ধারাবাহিক লেখা হতেই চলেছে। এতে বুঝে আসে কিতাবের সকল বিষয় শরাহ থেকে হল (আয়ত্ব) হয় না; বরং কিছু বিষয় এমন থাকে যেগুলো ফন থেকে সমাধান করতে হয়।
৩। ফলাফল বের করা। মুদাররিস সাহেবদের পড়ার মধ্যে তৃতীয় যে বিষয়টা শামিল থাকে তা হলো যা কিছু তিনি পড়েছেন এবং খুলাসা নোট করেছেন সেটা নিয়ে গভীর ভাবে ভাববেন। এর মধ্যে কোন প্রশ্ন দেখা দিলে সেটার জওয়াব নিয়েও ভাববেন। কোন সূক্ষ্ম বিষয় থাকলে সেটা সমাধানের জন্য ফিকির করবেন এবং বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে নতুন নতুন বিষয় তৈরী করবেন। এর দ্বারা ইসতিদাদ বাড়তে থাকবে।
হযরত ইবরাহীম বিলইয়াভী রহ. এর মূল্যবান নসীহত-
আমি যখন দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে দারুল উলূম আশরাফিয়া (রান্দির) এর মুদাররিস হয়ে রওনা হব তখন আমার উস্তাযে মুহতারাম আল্লামা ইবরাহীম বিলয়াভী রহ. এর সাথে শেষ সাক্ষাতে গিয়ে তাকে বললাম হযরত! আমাকে এমন কিছু নসীহত করুন, যেটা আমি আমার জীবনের মূলমন্ত্র বানিয়ে নেব। হযরত রহ. বললেন, মওলভী ছাহেব! (ক) ‘ফন দেখে কিতাব পড়াবে, শরাহ দেখে নয় তাহলে ইলম আসবে। (খ) তলাবাদেরকে নিজের সন্তান মনে করবে। তাহলে সে তোমাকে মুহাব্বত করবে। (গ) সুন্নাতের পাবন্দি করবে তাহলে লোকদেও মাঝে তোমার গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হবে।’ এ তিনটি কথা আমার জীবনে কী পরিমাণ উপকাওে এসেছে তা আমি বলে শেষ করতে পারব না।
না পড়ে শুধু পড়ানোর দ্বারা ব্যক্তি তৈরী হয় না
বর্তমানে দুঃখজনক বিষয় হল, উস্তাদগণ পড়াচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তেমন যোগ্য ব্যক্তি তৈরী হচ্ছে না। একটা দৃষ্টান্ত নিয়ে ভাবুন- একজন মধ্যম পর্যায়ের ছাত্র সে আরবী প্রথম জামাত শুরু করে। সাত থেকে আট বছরের মধ্যে বুখারী শরীফ পড়ার উপযুক্ত হয়ে যায়। এরপর সে মুদাররিস হয়ে যায়। কিন্তু বিশ বছর পড়ানোর পরেও বুখারী শরীফ পড়ানোর উপযুক্ত হয় না। অথচ তার পাঁচ বছরের মধ্যেই বুখারী শরীফ শরীফ পড়ানোর মত যোগ্য হওয়ার দরকার ছিল। না হওয়ার কারণ হল এটাই যে, সে ছাত্রদের পড়ায় ঠিকই কিন্তু নিজে পড়ে না। মিশকাত শরীফ পড়ায় তো ব্যাস শুধু ওটাই পড়ায়; ফন্নী কোন কিতাব পড়ে না। কিছু কিছু মুদাররিস আমাকে জিজ্ঞাসা কওে, হযরত আমার নাসাঈ বা ইবনে মাজাহ পড়ানোর সুযোগ এসেছে, আমি এখন কোন শরাহ দেখব? আমি বলি তুমি ফাতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী দেখ। তখন সে বলে বুখারীতে নাসাঈ ও ইবনে মাজাহর হাদীস খুঁজে তার শরাহ দেখা অনেক সময় সাপেক্ষের ব্যাপার। এটা আমার দ্বারা কতটুকু হবে! তখন আমি তাকে বলি, তাহলে তো তুমি নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ পড়ানোর উপযুক্ত নও। হাদীসের কোন একটা কিতাব পড়ানোর সুযোগ হল আর সে বিষয়ের পূর্ণ ফন দেখল না, তাহলে তো সে ছাত্রদের পড়াল; কিন্তু নিজে পড়ল না। এভাবে শত বছর পড়ালেও ইলম আসবে না। কেননা ইলম তো পড়ার দ্বারাই অর্জন হয়।
এক্ষেত্রে আসাতিযায়ে কেরাম দুটি প্রশ্ন করে থাকেন-
১ম প্রশ্ন: আসাতিযায়ে কেরাম বলে থাকেন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আমাদেও পদোন্নতি দেয় না। তারা যদি আমাদের কোন বড় কিতাব দিতেন তাহলে আমরা মুতালাআ করতাম। পাঁচ বছর ধরে আমাদেরকে (মানতেক শাস্ত্রের) মিরকাত কিতাবে আটকে রেখেছে। তাহলে আমরা (মানতেক শাস্ত্রের উঁচু মানের কিতাব) ‘মোল্লা হাসান’ কিভাবে মুতালাআ করব? অথবা দশ বছর ধরে আমাদেরকে (ফিক্বহের) কুদূরী কিতাবের মধ্যে ফেলে রেখেছে, কানযুদ দাকায়েক বা শরহে বেকায়া দেয় না। তাহলে আমি মুতালাআ করব কিভাবে?
উত্তর: আমি বলি, তোমার শিশিতে কি কিছু আছে? যদি ভাল সুগন্ধি বিশিষ্ট খোশবু থাকে তাহলে সুগন্ধি ছড়াও। দেখবে প্রত্যেকে জিজ্ঞাসা করবে- কে এই সুগন্ধি ব্যবহার করেছে, খুব দারুণ খোশবু তো! বর্তমানে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যোগ্যতাসম্পন্ন উস্তাদের জন্য পেরেশানিতে থাকে। কিন্তু কেউ সুন্দর সুঘ্রাণ ব্যবহার করলে অন্যরা তাকে জিজ্ঞাসা করবে। আসলে প্রথমে পড়তে হবে এবং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। তাহলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিবে। অযোগ্যকে এই আশায় পদোন্নতি দেওয়া যে, পরবর্তীতে সে যোগ্য হয়ে যাবে; এটা মূর্খতা সুলভ কথা। অবশ্য যোগ্যতার সাথে সাথে সুসম্পর্কেরও প্রয়োজন আছে; তোষামোদ বা চাটুকারিতার কোন প্রয়োজন নেই। সহজ করে বললে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সাথে এই ধরনের হৃদ্যতা জরুরি যে তারা তোমাকে নিজেদের জন্য এবং মাদরাসার জন্য কল্যাণকর মনে করবেন। তাহলে দ্রুতই তারাক্কী পাওয়া যাবে। আর তোমার সম্পর্ক যদি হৃদ্যতাপূর্ণ না হয় এবং মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে অসন্তোষজনক সম্পর্ক থাকে এবং মুহতামিম সাহেব তোমাকে নিজেদের বা মাদরাসার হিতাকাঙ্খী মনে না করেন তাহলে হয়ত তোমার তারাক্কী (উন্নতি) হবে না। কারণ তোমাকে পদোন্নতি দিয়ে কেন তিনি নিজেদের উপর মসিবত ডেকে আনবেন? তবে কিছু লোক মনে করে তোষামোদেও তো কাজ হয়। কারণ
(الدنيا بالوسائل لا بالفضائل)
অর্থাৎ দুনিয়ার কর্মফল ওসীলা দ্বারা নির্ধারিত হয়; ফযীলত দ্বারা নয়। এক্ষেত্রে আমার খেয়াল হল, এ কথা সঠিক নয়। মুদাররিসের মূল দায়িত্বে সচেতন হওয়া উচিত। মাদরাসা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মাথা ঘামানো উচিত নয়। কারণ মাদরাসা তার নয়; মাদরাসা অন্যের। তারা তাদের কাজ সম্পর্কে ভালভাবে অবগত। যদি কোন মুদাররিসের মুহতামিম হওয়ার আগ্রহ থাকে এবং শিক্ষা সংস্কারের ইচ্ছা থাকে তাহলে তিনি নতুন একটা প্রতিষ্ঠান খুলে নিক। আল্লাহর জমিন সঙ্কীর্ণ নয় এবং অভাবীর পাও খোঁড়া নয়। অন্যদের মাদরাসায় ওলট পালট ও বিশৃঙ্খলা করে নিজের অবস্থান নষ্ট করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: উস্তাদগণ বলে থাকেন- মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আমার উপর এত কিতাব চাপিয়ে দিয়েছে; আমি কিভাবে সব ফন দেখব?
উত্তর : আমি বলি, যদি আপনার কাছে পাঁচ ধরনের কিতাব থাকে তাহলে চারটি কিতাব শরাহ দেখে পড়ান। একটি কিতাব ফন দেখে পড়ানোর জন্য নির্বাচন করুন। দু’ তিন বছরে পূর্ণ ফন আয়ত্ব করে নিবেন। এরপর নতুন ফন ধরবেন। এভাবে ধারাবাহিক কয়েকটি ফন দেখা যেতে পারে। আর যদি আপনার ইচ্ছাই না থাকে তাহলে আপনার জীবন পার হয়ে যাবে কিন্তু কোন ফনের উপর আপনি দক্ষ হতে পারবেন।
সারকথা হল এই যে, রিজাল (যোগ্য ব্যক্তি) তৈরির এই দুর্ভিক্ষের যামানায় মাদরাসা শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের জন্য উচিত হল, সে ফারেগ হবে না। এই ‘ফারেগ হওয়া’ শব্দ মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিবে। অনুরূপ ভাবে ফাযেল (ডিগ্রিপ্রাপ্ত) হওয়ার অনুভ‚তিও শেষ করে দিবে। ভিতরে তালিবুল ইলম থাকার অনুভ‚তি জাগ্রত রাখবে। কেননা ফাযেল শব্দটি তো কখনো ‘ফুযূল’ (অতিরিক্ত, অনর্থক) শব্দ থেকেও আসতে পারে। তাহলে কি আপনি খড়কুটার মত অনর্থক? আর থাকল ‘ফাযেল’ যেটা ‘আল্লামাতুত দাহ্র’ বা যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী- এর অর্থে এটা তো খাটি লাল স্বর্ণের ন্যায় যা শতাব্দিতে অল্প কিছু তৈরী হয়ে থাকে। ময়দানে তো লাখো মানুষের বিচরণ থাকে, কিন্তু গন্তব্যে কয়জন পৌঁছতে পারে! সুতরাং যখন তুমিও দেওয়ানার মত চলতে থাকবে তখন আশা করা যায় তুমি গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
৪র্থ কথা
এটা তৃতীয় কথার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু এর গুরুত্বের বিবেচনায় ভিন্ন করে আলোচনা করছি। প্রশ্ন হল, অসংখ্য দ্বীনী মাদারিস রয়েছে। তারা সেখানে পড়া এবং পড়ানোর মধ্যে লিপ্ত আছেন। এরপরেও কেন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি তৈরী হচ্ছে না? কেন রিজাল তৈরির দুর্ভিক্ষ চলছে?
উত্তর: এর কারণ দুইটা। একটা কারণ তো আলোচনা হয়ে গেছে, লোকেরা পড়ায় কিন্তু নিজে পড়ে না। আর দ্বিতীয় কারণ হল, মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপনকারী তিন ধরনের হয়ে থাকে। ১। উচ্চ পর্যায়ের ২। মধ্যম পর্যায়ের ৩। নি¤œ পর্যায়ের। ফুযালাদের প্রথম শ্রেণী তো সাধারণত নষ্ট হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। কম্পিউটার ও অন্যান্য কলাকৌশল শিখতে লেগে যায় অথবা অন্যান্য লাভজনক কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর ফুযালা আরবী মাদরাসায় খেদমত শুরু করে। যেহেতু তাদের অবস্থান ১ম শ্রেণীর তুলনায় নি¤œ মানের। সেজন্য তারা অনেক চেষ্টা করেও তালগাছ (বড় কিছু) হতে পারে না। এটা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন- আল্লাহ তাআলা উদ্ভিদ ও প্রাণীদের মধ্যে সকলের জন্য একটি লেবেল ও স্তর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রতিটি মাখলূক তার নির্দিষ্ট সীমায় গিয়ে থেমে যায়। যেমন মরিচ গাছের চারার একটা সীমা আছে, গম-খাদ্য শস্য চারার সীমা ভিন্ন। আম-জামের গাছের সীমাও ভিন্ন। তাল গাছ, খেজুর গাছ এবং নারিকেল গাছ অনেক লম্বা হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছ আপন সীমা পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়। এখন চিন্তা করুন, আম গাছ, জাম গাছ যখন আপন সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তখন সময় মত ঠিকই গাছের পাতা ঝরে যায়। আবার নতুন পাতা গজায়। কিন্তু ঐ গাছের লেবেল আগের মতই থাকে, আর বড় হয় না। এক সময় বয়স হয়ে নিচের দিকে নুয়ে পড়ে। মানুষের অবস্থাও এমন। প্রতিটি মানুষের জন্য একটা সীমা নির্ধারিত আছে। সে ঐ পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যায়। সে যতই চেষ্টা করুক সামনে অগ্রসর হতে পাওে না। সুতরাং মধ্যম শ্রেণীর ছাত্ররা সবধরণের চেষ্টা-মুজাহাদা করেও প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হতে পাওে না। আর প্রথম শ্রেণীর লোকেরা প্রথম শ্রেণীতেই থাকে; কিন্তু অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়।
ফুযালা কেন নষ্ট হয়ে যায়?
এক্ষেত্রে মাদরাসা কর্তৃপক্ষেরও কিছু ত্রæটি থাকে। আবার ফুযালারও কিছু ত্রæটি থাকে। অর্থাৎ কিছু স্বর্ণ খাঁদ যুক্ত থাকে আবার কিছু স্বর্ণকারও অসৎ থাকে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মুদাররিসকে এই পরিমাণ বেতন-ভাতা দেন না যা দ্বারা তারা জীবন চালিয়ে একনিষ্ঠতার সাথে আপন দায়িত্ব আঞ্জাম দিবে। যে শ্রমিক কাঁদা তৈরী করে তারও মাসে চার হাজার রুপি (বাংলাদেশে ১৫/২০ হাজার টাকা) আয় হয়। আর মুদাররিসগণের হয়ত মাসে দুই-আড়াই হাজার রুপি (বাংলাদেশের হিসাবে ৭/৮ হাজার টাকা) হাতে আসে। যে ব্যক্তি পনের বছর মেহনত করল এবং নিজের জীবনের মূল্যবান সময় পড়ালেখায় ব্যয় করল সে একজন কাঁদা তৈরীকারী শ্রমিকের সমানও হল না। তাহলে কি একজন শ্রমিকের যে পরিমাণ খরচ হয় সেই পরিমাণ খরচও মৌলভীর বাড়িতে হবে না? কিন্তু মাদরাসার দায়িত্বশীলরা এটা বুঝতে চায় না। বরং তারা এই খোঁড়া যুক্তি পেশ করে যে, মাদরাসার এ ধরনের সক্ষমতা নেই। তখন তো প্রশ্ন হয়, তাহলে বিল্ডিং কোত্থেকে তৈরী হচ্ছে? মুহতামিমই বা কিভাবে মাদরাসার কাজের জন্য ঘুরছেন? আসল কথা হল, ব্যক্তি যদি ইচ্ছাই না করে তাহলে হাজারো অজুহাত সামনে আসে। যদি শ্রমিককে প্রয়োজন পরিমাণ পারিশ্রমিকই দেওয়া না হয় তাহলে সে জীবনভর একনিষ্ঠতার সাথে কিভাবে কাজ করবে? আর মানুষ তো উঁচু মানের মানুষ হয় নিজের পুরা যিন্দেগী ব্যবহার করার মাধ্যমে। দশ-বিশ বছর পড়ানোর দ্বারা কেউ শাইখুল হাদীস হয় না।
আর ফুযালার ত্রæটি হল, তারা কী পাচ্ছে, কী অর্জন হচ্ছে- এটা সামনে রেখে কাজ করে। অথচ ইলম তো ইলমের জন্যই শেখা হয়; মাল কামাইয়ের জন্য নয়। রিযিকের যিম্মাদারি তো আল্লাহ তাআলাই নিয়ে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই প্রত্যেকের পেট ভরে দেন। আর টাকা পয়সা তো তিনটা কাজে আসে। ব্যক্তি ভাল এবং উন্নত মানের খাবার গ্রহণ কওে, ভাল কাপড় পরিধান করে এবং লোকেরা তাকে দেখলে সালাম করে। এই বিষয়গুলো তো অল্প বেতনেই অর্জন হয়ে যাচ্ছে। ভাল খাবার, ভাল পোশাকের ব্যবস্থা এর দ্বারা হয়ে যাচ্ছে। আর আলেম যদি নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখেন তাহলে এলাকার সকল মানুষ তাকে সম্মান করবে এমনকি হিন্দুরা পর্যন্ত তাকে সমীহ করবে। তাহলে আর কী চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে!
অবশ্য স্ত্রী যেহেতু বাপের বাড়ি থেকেই ঘর পরিচালনা করা শিখে আসে, অবশ্য তাকে এব্যাপারে একটু দীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে এবং খরচের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থী হওয়াও শিখতে হয় এবং নিজেকেও অনর্থক খরচ থেকে বাঁচাতে হয়। যেমন আলেমদের জন্য মোবাইলের খরচটা অনর্থক। লোকদেও সাথে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে হয় করো; কিন্তু সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখার কী দরকার? অবশ্য যখন সন্তানাদি হয়ে যায় তখন বাস্তবিক পক্ষে পেরেশানিতে পড়তে হয়। যেটার সমাধান মাদরাসা কর্তৃপক্ষেরই ভাবা উচিত।
আমার শেষ কথা হল, এই মজলিস থেকে উঠার পর তোমরা শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যাবে। এক শ্রেণী হল যারা ভাল যোগ্যতা সম্পন্ন নয়। তারা হয় ইসলামী মকতবগুলোতে পড়াবে বা মসজিদে ইমামতি করবে অথবা অন্যান্য খেদমতে লেগে যাবে। তাদের সর্ব প্রথম এক সালের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া উচিত। কেননা বর্তমানে মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা বেশী হওয়ায় তারা যথাযথ দীক্ষা পাচ্ছে না। সুতরাং তাবলীগে এক বছর সময় দিলে দ্বীনী মেজায তৈরী হবে এবং সর্বসাধারণের সাথে কিভাবে মুআমালা করতে হয় সে যোগ্যতাও অর্জন হবে। এরপর সে যে কাজে ইচ্ছা মশগুল হতে পারবে।
দ্বিতীয় শ্রেণী, মধ্যম পর্যায়ের ফুযালা। যাদের এখনো পড়া উচিত। নিজেদের যোগ্যতাকে পূর্ণতায় পৌঁছানো দরকার। সে নিজেকে এখনো তালিবুল ইলম ভাববে। তাবলীগে বা অন্য কোন কাজে লাগবে না। বরং নিজের মনজিলে মাকসূদেও দিকে যেতে থাকবে।
তৃতীয় শ্রেণী, যারা পূর্ণ যোগ্যতা সম্পন্ন এবং নিজেকে নষ্ট করতে চায় না। বরং নিজেকে দ্বীনের কাজে নিয়োগ করতে চায়। সে পড়ানোর কাজে লেগে যাবে এবং রাত দিন নিজের কাজের মধ্যেই মগ্ন থাকবে। তাবলীগ জামাতে যাবে না। অন্যথায় এক বছর পরে সে কোন কাজই করতে পারবে না। ছাত্ররা দুই মাসের ছুটিতে বাড়িতে যায় তাই তারা অর্ধেক পড়া ভুলে যায়। আর এক বছর তাবলীগে গেলে তো তার থলিতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সে তার যোগ্যতা পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত একাগ্রচিত্তে পড়াতে থাকবে। এরপর তাবলীগ জামাতে গেলে কোন সমস্যা নেই। তখন তার যোগ্যতা নষ্ট হবে না; বরং তাবলীগের কাজ তার যোগ্যতা দ্বারা আরো শাণিত হবে। আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হল, এই সমস্ত হযরতগণ তাবলীগে বের হবে না। তারা যে কাজ করছে সেটাও দ্বীনের কাজ। তাবলীগের কাজই শুধু দ্বীনের কাজ নয়। আর এ বিষয়ের আলোচনা কিতাবুল জিহাদে এসেছে। উদ্দেশ্য একত্ববাদ গ্রহণ আর এক লাইনে লেগে থাকাতেই আসল সফলতা।
আর আমার এ কথাও স্মরণ রাখবে যে, প্রথম শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য দশ বছর, মধ্যম শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য ১৫ বছর এবং সাধারণ শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য ২০ বছর ধারাবাহিকভাবে রাতদিন মেহনত করে কিতাবের পোকা হয়ে যেতে হবে। এরপর থেকে ইলম আসা শুরু হবে। আর যখন ইলম আসা শুরু হবে তখন নিজেই অনুভব করতে পারবে যে, এখন আমার কিছু অর্জন হচ্ছে।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين